সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে কোনপথে দেশ

Spread the love

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে কোনপথে দেশ
-হাসান আল বান্না
২৪ জানুয়ারি ২০২৩

Mail Article Link
https://www.jugantor.com/viewers-opinion/638170/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%AA%E0%A6%A5%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6?fbclid=IwAR1BOkbMmN5LwBn3K_WZcvb0zlolx2xAICMk5hz1-siQwVGE_vVPiSPZ7T8

বিদেশি মিডিয়ার অবাধ প্রচারের সুযোগ থাকায় আমাদের দেশিয় মিডিয়ার দর্শক কমেছে। এর কারণে দেশি পণ্য বিক্রি বৃদ্ধির জন্য অনেকে বাধ্য হয়ে বিদেশি মিডিয়াকে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। যদিও এটা আইন ও বিধিসম্মত নয়। এই বিদেশি মিডিয়াগুলো আমাদের শুধু তরুণ ও যুব সমাজকে ধ্বংস করেনি, বলা যায় সব বয়সি মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

আমাদের মেয়েরা ঘরের একান্ত প্রয়োজনীয় কাজ সেরেই টেলিভিশনের সামনে বসেন, আর বিদেশি সিরিয়াল দেখেন, এসব সিরিয়াল মেয়েদের ভালো কিছু শেখায় না, কীভাবে পরিবারের মধ্যে কূটচাল করতে হয়, কীভাবে পরিবারের অশান্তি সৃষ্টি করতে হয় তা শেখানো হয়। ফলে এখন দেশের যৌথ পরিবার বিলুপ্তির পথে।

বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান আমাদের শিশুদের মধ্যে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে টিভিসেট অন করলে, কোনো দেশীয় চ্যানেলের দেখা মিলবে। অথচ বিদেশি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত কার্টুনে এমন কিছু চরিত্র থাকে যার সংলাপ ও মুখভঙ্গি শিশুসুলভ নয়।

এছাড়া কিছু কিছু টিভি সিরিয়ালে শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, অশালীন, ঝগড়া-বিবাদপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করানো হয়; যা আমাদের শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের অন্তরায় ঘটে। বহু সিরিয়ালে এমন কিছু চরিত্র, সংলাপ, কাহিনী প্রচার করা হয় যার প্রভাবে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিদেশি সব টিভি চ্যানেল বন্ধে রাজধানীসহ প্রায় সব জেলায় সভা-সেমিনার ও মানববন্ধন হয়েছে। বিভিন্ন সময় জীবন ধ্বংসকারী টিভি চ্যানেল বন্ধের জোর দাবি জানানো হয়েছে কিন্তু এসব বন্ধ হয়নি। ফলে অপসংষ্কৃতিও বন্ধ হচ্ছে না।

আমাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অথচ আমাদের এই নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আজ বিদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভেতর দিয়ে একটা দেশের নিজস্ব ইতিহাস, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ধরন উল্টাপাল্টা করে দেওয়া হয়। অস্পষ্ট করে তোলা হয় তার আত্মপরিচয়।

বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একটি দেশের একক সংস্কৃতি যখন অন্যান্য দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং অন্য সংস্কৃতির স্থান যখন সেই সংস্কৃতি নিয়ে নেয় তখন তাকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে। বাংলাদেশ এই আগ্রাসনের শিকার অনেক আগে থেকেই, এখন এই কুফল ভোগ করা শুরু হয়েছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেশের চলচ্চিত্রে যা ঘটছে তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। অশ্লীল সংলাপ ও কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য দিয়ে বানানো হয় সিনেমা। বিকৃত যৌনাচারও দেখানো হয় সিনেমায়। ক’দিন আগেও এদেশের ফ্যাশন শো‘র নামে কোনো শো হতো না এদেশে। এখন এসব শো হচ্ছে নিয়মিতই। সঙ্গীত ও অভিনয় প্রতিযোগিতা ছিলোনা, এখন আছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে বিদেশি সাংস্কৃতির তীব্র বিরোধীতা করা হলেও সেটি বন্ধ হয়নি, সরকার এই অশ্লীলতা বন্ধ করেনি।

বিউটি পার্লারের নামে যা হচ্ছে তা সবাই জানেন, এই পার্লারের নামে অবৈধ যৌন চর্চা আগে ছিল না। অভিজ্ঞরা মনে করছেন দেশের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য বড় দায়ী সিনেমা ও টেলিভিশনে অপসংস্কৃতির প্রচারণা। বিশেষ করে বিদেশি চলচ্চিত্রের অশুভ প্রভাব পড়েছে আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনে। চলচ্চিত্রে এখন স্বল্প বসনা নারীদের পদচারণা খুবই বেশি। শিল্পের ছোঁয়া নেই এসব অভিনয়ে।

উত্তেজনা দৃশ্যসমূহে শিহরিত হয় দর্শকরা। কাটপিচ দৃশ্যের নামে চলচ্চিত্রে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে পর্নোগ্রাফি।
বিদেশি চলচ্চিত্রে তরুণদের বিয়ার খাওয়ার দৃশ্য, চুমুর দৃশ্য, দেখানো হচ্ছে শারিরীক সর্ম্পকের দৃশ্য, এসব দেখে আমাদের তরুণরা মত্ত হচ্ছে নেশা, মাদক এবং অবাধ যৌনাচারে। বিদেশি সংস্কৃতির মরণ ছোবল আমাদের সম্ভবনাময়ী যুব সমাজকে অপরাধপ্রবণও করে তুলেছে। ৯০ শতাংশ সিনেমাতে নায়ক-নায়িকা সব ধনকুবের। চোখ ধাধাঁনো বাড়ি, গাড়ির মালিক। এরা অভিনয় করে জিন্স আর গেঞ্জি পরে, অনেকের বেশভূষা, চুলের ছাট অত্যন্ত হাস্যকর। এসবই নতুন প্রজন্মেও মাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গত ১ অক্টোবর মিরপুর সেনানিবাসে একটি হল রুমে প্রবীণদের দিবস উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর অবরসপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিবসহ সাবেক বেশ কয়েকজন সচিব, সাহিত্যিক ও গবেষকরা অংশ নিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে লেখক ও গবেষক হাসান আলী বলছিলেন, এক সময় আমাদের যৌথ পরিবার ছিল, এখন নেই, যৌথ পরিবারের পর শুরু হয়েছিল একক পরিবার, অর্থ্যাৎ স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকার ব্যবস্থা। এখন সেই একক পরিবারও হারিয়ে যাচ্ছে। স্বামী ও স্ত্রী আলাদাভাবে থাকা শুরু করেছে। চাকরি, কর্মস্থল দুই জায়গায় হওয়া, মতের অমিলের কারণে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকছেন, আর স্বামী থাকছেন আলাদা। এছাড়া অনৈতিক সম্পর্কের জেরে ভেঙে যাচ্ছে বেশিরভাগ সংসার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসবই হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নেতিবাচক প্রাপ্তি।

১৯৯৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেসের জন্য প্রণীত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহে পশ্চিমের ব্যর্থতার প্রধান কারণ হচ্ছে ‘ইসলামের পরিবার প্রথা’। তাই বর্তমানে মিডিয়ার মাধ্যমে পরিবার প্রথার উপর তীব্র আঘাত হানা হচ্ছে। পারিবারিক জীবনের সুন্দরতম দিকগুলো উপেক্ষা করে মানুষদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে অবাধ যৌনাচারের দিকে। তরুণ-তরুণীকে শুধু তাদের দু’জনের প্রগাঢ় বন্ধনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে নারী সমাজের ভেতর একজন আদর্শ স্ত্রী, বোন, ভাবি, চাচি, দাদি, নানি ইত্যাদি হওয়ার চাইতে কেবল একজন প্রেমিকা হওয়ার প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এছাড়া প্রতিনিয়ত তালাক, পারিবারিক কলহ, পরকীয়ার শিকার হয়ে ঘর পালানোর খবর, ধর্ষণ ও সম্ভম হানির সচিত্র বর্ণনা ও লৌমহর্ষক ঘটনা পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় তা আমাদের পরিবার প্রথার ভাঙ্গনের খবরই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, তা যেন আমাদের এক অবশ্যম্ভাবী পতনমুখী খবরও দেয়।

অভিজ্ঞরা বলছেন- সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য সুস্থ, রুচিশীল, এবং দেশীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে এগিয়ে আসতে হবে। শক্তিশালী মিডিয়ার মাধ্যমে সকল আগ্রাসনের যুক্তিপূর্ণ জবাব দিতে হবে। হতে হবে দেশীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক বাহক। দেশপ্রমিক ও নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে শক্তিশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করতে হবে। নিজস্ব ও ইসলামি সংস্কৃতি অনুযায়ী সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে। জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নীতি-নৈতিকতার সমন্বয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

সরকারি পৃষ্টপোষকতায় সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে সুস্থ সংস্কৃতির আলোক রশ্মি। অপসংস্কৃতির ক্ষতিকর দিকসমূহ মিডিয়ার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। অপসংস্কৃতি বর্জন করে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার এক নির্মল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাদের ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাদের বানাতে হবে দেশীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির সূতিকাগার। অপসংস্কৃতির প্রবেশধারকে তার রূপ পাল্টিয়ে নিজস্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির আলোকে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের চলচ্চিত্র জগৎকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। দেশীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: